পবিত্র মাহে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে শাবান মাস। আর এ মাসের শেষেই শুরু হয় মুমিনের কাক্সিক্ষত পবিত্র মাহে রমজান। রমজান মাস হলো মুমিনের জন্য সিয়াম সাধনার মৌসুম। সারা বছর আমরা যেহেতু সিয়াম-বিমুখ থাকি, তাই শাবান মাস আসে আমাদের উজ্জীবিত করতে। রমজান মাস যেমন ফরজ সিয়ামের মৌসুম, শাবান মাস তেমনি নফল সিয়ামের মৌসুম। দীর্ঘ ১১ মাসের জড়তা-অলসতা কাটিয়ে শাবান মাস আসে আমাদের উদ্দীপ্ত করতে। তাই তো রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘রমজান ও রজবের মধ্যবর্তী এ মাসের ব্যাপারে মানুষ উদাসীন থাকে। অথচ এটি এমন মাস, যে মাসে বান্দার আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই, আল্লাহর কাছে আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি সিয়াম পালনরত।’ (নাসায়ি-২১৭৯)
শাবান মাস নিছক আবেগ-উচ্ছ্বাসের ব্যাপার নয়; বরং ইবাদত-রিয়াজতের বিশেষ বার্তাবাহী। আল্লাহর রাসূল সা: শাবান মাসে এত অধিক নফল সিয়াম পালন করতেন যে, অনেকেরই মনে হতো তিনি বোধ হয় আর সিয়াম ভঙ্গ করবেন না। এ ব্যাপারে হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: একাধারে (এত অধিক) সিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) সিয়াম পালন না করা অবস্থায় একাধারে সময় কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে রমজান ছাড়া কোনো পুরো মাসের সিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শাবান মাসের চেয়ে কোনো মাসে অধিক (নফল) সিয়াম পালন করতে দেখিনি।’ (বুখারি-১৯৬৯)
অথচ আমরা কী করি- আমাদের দেশে শাবান মাস এলে শুরু হয় ইবাদতের নামে অনেক অবাঞ্ছিত কর্মকাণ্ড। যেমন হালুয়া-রুটি খাওয়া ও আতশবাজি করা। এসব কর্মকাণ্ড কখনো ইবাদত হতে পারে না।
আমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণ-অনুকরণ ব্যতীত মুক্তির কোনো উপায় নেই। সবধরনের ইবাদত তাঁর সুন্নাহ মোতাবেক পালন করা জরুরি। রাসূল সা:-কে ভালোবাসা ও তাঁর প্রতি দরূদ পড়াও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শুধু তাই নয়, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর ওপর দরূদ পাঠ করেন এবং আমাদেরও দরূদ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা নবীর প্রতি পরিপূর্ণ অনুগ্রহ নাজিল করেন, তাঁর ফেরেশতারা নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হে মুমিনরা! তোমরাও নবীর জন্য দরূদ তথা অনুগ্রহ প্রার্থনা করো এবং যথাযথ শ্রদ্ধাভরে তাকে সালাম জানাও।’ (সূরা আহজাব-৫৬)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর নফল সিয়ামের বর্ণনায় বুখারির হাদিসের পাশাপাশি মুসলিমেও আয়েশা সিদ্দিকা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: কখনো কখনো ধারাবাহিকভাবে সিয়াম রাখতেন। আমরা বলতাম, তিনি মনে হয় আর কখনো সিয়াম ছাড়বেন না। আবার কখনো এভাবে সিয়াম রাখা ছেড়ে দিতেন যে, আমরা সেহেতু বলাবলি করতাম, তিনি মনে হয় আর কখনো সিয়াম রাখবেন না। রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে পুরো মাস সিয়াম রাখতে দেখিনি। শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এত বেশি সিয়াম রাখতে আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে দেখিনি।’ (মুসলিম-১১৫৬)
উম্মে সালামা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে টানা দুই মাস সিয়াম রাখতে দেখিনি। তবে তিনি রমজানের সাথে শাবান মাসেও লাগাতারভাবে সিয়াম রাখতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ-২৬০২২)
রমজান যখন একেবারে দ্বারপ্রান্তে তখন নফল সিয়ামের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা: সতর্ক করেছেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের এক দিন বা দুই দিন আগে সিয়াম রাখবে না। তবে কারো যদি সিয়াম রাখার অভ্যাস থেকে থাকে সে ব্যক্তি সিয়াম রাখতে পারে।’ (বুখারি-১৯১৪)
আমাদের দেশে ১৫ শাবানে শবেবরাতের সিয়াম বলে যে কথা প্রচলিত আছে তা সুন্নাহসম্মত নয়। তবে ১৫ তারিখে সিয়াম রাখা নিষেধ নয়; কিন্তু একে শবেবরাতের সিয়াম বলা যাবে না। গোটা শাবান মাসেই শুধু শেষের দু’দিন ছাড়া, সিয়াম পালন করা যায়। তা ছাড়া প্রতি মাসের ‘আইয়্যামে বিজ’ (চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) সিয়াম পালন মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের সিয়াম রাখা হলে ইনশাআল্লাহ সওয়াব পাওয়া যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে মনে রাখতে হবে, নফল সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে যেন বাড়াবাড়ি না হয়। কেননা, আল্লাহর রাসূল সা: একটানা নফল সিয়াম পালনের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ আছে যে, নবী সা: একটানা সওম পালন করতে থাকলে লোকেরাও একটানা সওম পালন করতে শুরু করে। এ কাজ তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। নবী সা: তাদের নিষেধ করলেন। তারা বলল, আপনি যে একনাগাড়ে সওম পালন করছেন? তিনি বললেন, ‘আমি তো তোমাদের মতো নই। আমাকে খাওয়ানো হয় ও পান করানো হয়।’ (বুখারি-১৯২২)
লেখক : সাংবাদিক